বিজ্ঞানের জন্ম কীভাবে?

অন্য সকল মহাকাব্যের মতই বিজ্ঞানের গল্পও শুরু হয় “সে অনেককাল আগের কথা” দিয়ে। সেই প্রাচীনকালে, মানুষ যখন চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে; তখন থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছে, ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। মানবপ্রজাতির সেই চেষ্টার ধারাবাহিকতাতেই, ধীরে ধীরে আমরা আজকের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাগুলোতে উপনীত হয়েছি। সেই ধারাপ্রবাহের প্রথম ধাপ ছিলো পুরাণ বা Myth.
প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে উপাখ্যান তৈরি হয়েছে। এ ওকে বলে গেছে, সে তার পরের প্রজন্মকে বলেছে। প্রত্যেক প্রজন্মে গল্পগুলো একটু একটু করে পাল্টে গেছে, সাধারণ মানুষের বীরত্বের কাহিনীগুলো হয়ে গেছে দেবতাসুলভ। কাহিনী হয়ে গেছে কিংবদন্তী, কিংবদন্তী রুপান্তরিত হয়েছে পুরাণে। Lord of the rings: Fellowship of the ring চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে এমন একটা উক্তি ছিলো – “History became legend, legend became myth”. রাহুল সাংকৃত্যায়নের “ভোলগা থেকে গঙ্গা” বইটার মধ্যে খুব চমৎকারভাবে পুরাণ তৈরি হওয়ার একটা ধারাপ্রবাহ দেখানো হয়েছে। যাদের বইটা পড়া নেই, তাদের সবাইকে বইটা পড়ার জন্য অনুরোধ করছি।
যাই হোক, এসব মিথ বা পুরাণ তৈরি হওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার একটা প্রয়াস ছিলো। তাদের কাছে, প্রকৃতি ছিলো রহস্যে ভরপুর। সবসময়েই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে প্রকৃতিতে। যেমন, পুরো আকাশ আলোকিত করে বজ্রপাত হচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ  কেন যেন পানি পড়ছে, মাটিতে বীজ পড়লে সেখান থেকে কীভাবে যেন গাছ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বা ফসল ফলছে, রাতের বেলা সূর্য কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে মানুষ যারপরনাই অবাক হয়েছে। আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের কাছে অতীতের কোনো ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখা ছিলোনা। তাদের কাছে এমন কোনো যন্ত্রপাতি ছিলোনা, যা দিয়ে তারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিছু মেপে দেখতে পারে। তারা সবচেয়ে কম পরিশ্রমে যে ব্যাখ্যাটা দাঁড় করাতে পেরেছিলো, সেটাকেই গ্রহণ করেছিলো। অবশ্য গ্রহণ করার মত অন্য কোনো বিকল্প তো ছিলোই না। একমাত্র ব্যাখ্যাটাই ছিলো, রহস্যময় এক সত্তার প্রভাব—এমন এক সত্তা যার ক্ষমতা আছে সূর্যকে রাতের বেলা লুকিয়ে ফেলার, মাটি থেকে গাছ টেনে তোলার, বা চাঁদকে একেক সময়ে একেক আকৃতি দেয়ার। শুধু উর্বরতা আর বজ্রপাত নিয়েই বলি—নর্ডিক পুরাণে উর্বরতার দেবী ফ্রেইয়া, এবং বজ্রপাতের দেবতা থর। একই রকম দেব-দেবী গ্রীক (Demeter and Zeus), মিশরীয় (Amun or Isis, and Seth), রোমান (Fecunditus or Venus, and Jupiter), বা উপমহাদেশীয় (অদিতি/ভূমি আর ইন্দ্র) পুরাণেও পাওয়া যাবে।
এখান থেকে কাহিনী দু ভাগ হয়ে গেলো। প্রায় সব সভ্যতাতেই এই ধারণাগুলোকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে তৈরি হলো সুসংগঠিত ধর্ম। আর প্রাচীন গ্রীসে কয়েকজনের মনে হলো, এই ব্যাখ্যাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। তারা বললেন, সবকিছুকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এই পুরাণকে ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমেই জন্ম নিলো দর্শন। এরিস্টটলের মতে, ৬০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করে যাওয়া থেলিস ছিলেন আমাদের প্রথম দার্শনিক। তবে একজনের আবির্ভাবের আগে পুরো জিনিসটাই খাপছাড়া ছিলো। তিনি এসে এটাকে একটা শক্ত ভিত্তি দিলেন। এজন্য এখনো অনেকে তাকেই প্রথম দার্শনিক বা ফিলোসফার বলে অভিহিত করেন—তার নাম সক্রেটিস। কম কষ্ট সহ্য করেননি তিনি তার ধারণাগুলো প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু, সেজন্যেই হয়তো আমরা এখনো সক্রেটিসের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। উনি একটা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা আজো জ্বলছে।
ধর্ম আর দর্শন, দুটোই প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। ধর্ম যেখানে গুরুত্ব আরোপ করেছে নিজেকে সংঘবদ্ধ রুপ দান করতে, পুরাতন ব্যাখ্যাগুলোকে আঁকড়ে ধরতে; দর্শন চেয়েছে কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা, সেটাকে চিহ্নিত করতে। স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে গেলো খুব দ্রুত। দর্শন রয়ে গেলো কেবল ছিদ্রান্বেষীদের হাতে, অবশ্য এর গতি কমলোনা কিন্তু। কারণ, দর্শনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিরা, যেমন – সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো, এবং প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল, এমন আরো অনেকে। ধর্ম পুরনো গল্পগুলোকে নতুন রুপে উপস্থাপন করলো, আর Philosophy (Phil + Sophie = Love + Wisdom) নিজেকে যুক্ত করলো জ্ঞানের ভালোবাসায়, নতুন জ্ঞান তৈরির কাজে।
আর এভাবেই জন্ম বিজ্ঞানের। যদিও মাঝখানে আরেকটা ধাপ আছে, Naturalism, তবুও সেটাকে আলোচনার জটিলতা কমাতে বাদ দিয়ে গেলাম। তবে এটা জেনে রাখা ভালো, এখনকার যুগে আমরা যাদেরকে বিজ্ঞানী বলে আখ্যা দেই, একসময় তাদেরকে ন্যাচারালিস্ট বলেই অভিহিত করা হতো। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করার মত, বিজ্ঞানও আসলে দর্শনই, তবে আরেকটু কঠোর রুপ।
যাই হোক, চিন্তাভাবনা করে হাইপোথিসিস দাঁড় করানোটাকে দর্শনের কাছ থেকে ধার করলো বিজ্ঞান, কিন্তু মনোনিবেশ করলো সেই হাইপোথিসিসগুলোকে যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করে তত্ত্ব বা থিওরিতে রুপান্তরিত করতে। বিজ্ঞান বললো, “আমরা এখনো তেমন কিছুই জানি না, এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব”। এই পদ্ধতিটাই আমাদেরকে পাল্টে দিলো।
“কেন আমাদের বিজ্ঞান বোঝা দরকার” শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল সেগান বলেছিলেন, “বিজ্ঞান শুধু জ্ঞানের একটা ভাণ্ডার নয়, এটা আসলে চিন্তার একটা প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানের সার্থকতা এই চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত। বিজ্ঞান বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে শেখায়, আমাদের পূর্ববর্তী ধারণা সেগুলো সমর্থন না করলেও। বিজ্ঞান আমাদেরকে পরামর্শ দেয় অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলোকেও যাচাই করে দেখতে; যাতে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যাটা বের করা যায়। যতই প্রচলিত জনমতবিরোধী হোক না কেন, নতুন ধারণার প্রতি আমাদেরকে উদার হতে শেখায় এটা। নতুন ধারণা বা প্রতিষ্ঠিত সত্য, দুটোকেই কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখায়।”
এটা ছিলো বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আমাদেরকে দুটো জিনিস মনে রাখতে হবে। এক, এই যাত্রা সম্ভব হয়েছে পরিচিত ধারণার বাইরে বের হয়ে নতুন চিন্তা করতে সক্ষম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য। আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাই। দুই, যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি। একজনের পর একজন নতুন চিন্তার মশাল বহন করেছেন বলেই আজ আমরা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমাদের প্রজন্মকে আরো বেশি করে বিজ্ঞানঘেঁষা হতে হবে, আরো বেশি করে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। সেই চিন্তার জায়গা থেকেই আমাদের ম্যাগাজিন “বিজ্ঞানযাত্রা”-র সূত্রপাত।




আলোর গতি কীভাবে বের করা হয়েছিলো?


গ্রীষ্মের আকাশে অগ্নিকুণ্ডের মত সূর্য জ্বলজ্বল করে, বাঁচার জন্য ছায়া খুঁজে বেড়াই। শীতের ঠাণ্ডায় সেই সূর্যেরই আলোতে দাঁড়িয়ে সূর্যস্নানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি আমরা। অনেকেই ব্যাপারটা জানেন – সূর্যকে যদি বাতির মত সুইচ টিপে নিভিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীবাসীর সেটা জানতে লেগে যাবে পাক্কা ৮ মিনিট। মানে, পৃথিবীর যে পাশে সূর্যের আলো পড়ছিলো, আরো ৮ মিনিট ধরে সেই পাশ আলোকিত হয়ে থাকবে। অনেকের কাছে ব্যাপারটা ধাক্কার মত আসে। দৈনন্দিন জীবনে তো এমন কিছু ঘটে না। লাইট জ্বালালেই দুম করে আলো জ্বলে ওঠে, একদম সাথে সাথে। লাইট নেভালে তো ৮ মিনিট পরে নেভে না। তাহলে, সূর্যের আলো এরকম ধোঁকাবাজি কেন করবে? উত্তরটা সরল – সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেণ্ডের মত সময় লাগে। আলোর গতি অনেক, কিন্তু অসীম না। আলোর সেই গতি প্রথমবার কিভাবে বের করা হয়েছিলো? কে করেছিলো?
উত্তর দেয়ার আগে একটা খেলা খেলি। বলুন দেখি, আলোর গতি জিনিসটা কোন সালে (বা কোন শতাব্দীতে) বের করা হয়েছিলো? আমি বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে গেলেই তাদেরকে এ ধরনের কিছু প্রশ্ন করি। তারা মনে করে, এ ধরনের জটিল প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগই সমাধান করা হয়েছে গত শতকে, খুব বেশি হলে উনিশ শতকে। মজা হয়, যখন বয়স্করাও তাদের জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করার পরেও ঠিক এমনটাই মনে করেন। যাই হোক, এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সতের শতকে, ১৬৭৬ সালে। আসুন, এইবার আসলে প্রশ্নের উত্তরটা দেখি – আলোর গতি কীভাবে বের করা হয়েছিলো! আমি কোনো জটিল হিসেব-নিকেশে যাবো না। শুধু গল্পটা বলার চেষ্টা করবো।
মহাবিশ্বে সবকিছু বেশ নিয়ম মেনে চলে। যেমন, পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর প্রায় ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে আসে। এজন্য ২৪ ঘণ্টায় দিন-রাত হয়। কখনো ২৬ ঘণ্টা বা কখনো ২২ ঘণ্টা, এরকম হয় না। পৃথিবীর কক্ষপথ দেখতে কেমন, কেন এমন – নিউটন সাহেব তো এইসব নিয়মগুলো পর্যবেক্ষণ করে সেরা সেরা কিছু সূত্র দিয়ে দিলেন। সেগুলো দিয়ে সুন্দরমত মহাকর্ষ ব্যাখ্যা করা গেলো – অমুক ভরওয়ালা কোনো বস্তু তমুক ভরওয়ালা কোনো বস্তুর চারপাশে কিভাবে, কত গতিতে, কতক্ষণে ঘুরবে, এগুলো আগের চেয়ে অনেক সূক্ষ্মভাবে হিসাব করা গেলো। যেমন ধরুন, চাঁদ মামা ঠিক কোন সময়ে পৃথিবীর কক্ষপথের কোথায় থাকবে, সেটার হিসাব নিখুঁতভাবে করা গেলো।
গোল বাঁধলো বৃহস্পতির চাঁদ নিয়ে, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চাঁদগুলোর (একাধিক) কক্ষপথ নিয়ে। নিউটন সাহেবের হিসাব বলছে, চাঁদগুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘোরার অমুক সময়ে পৃথিবী থেকে চাঁদগুলোকে অমুক জায়গায় দেখা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, ঘটনা সেভাবে ঘটছে না। কোনো কোনো সময় একদম টাইমমত চলে আসে, কখনো সময়ের ৮ মিনিট আগেই চলে আসে, আবার কখনো ৮ মিনিট পরে আসে। নিউটন ব্যাটা কি তাহলে ভুল করলো?
ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ ওলে রয়মার (Ole Rømer) ১৬৭৬ সালে দেখলেন, কাহিনীতে আরেকটা তথ্য যোগ করার দরকার। শিডিউলের (মানে, হিসেব করে বের করা সময়ের) আগেই চাঁদগুলোকে দেখা যায়, যখন বৃহস্পতি ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে। আর শিডিউলের পরে আসে, যখন বৃহস্পতি পৃথিবীর চেয়ে দূরে থাকে। তিনি আসল পর্যবেক্ষণটা করেছিলেন বৃহস্পতির একটা চাঁদ ইয়ো (IO)-এর চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে। সেই সময় তিনি অদ্ভুত একটা দাবি করলেন – যেখানে ঘটনাটা ঘটে, সেখান থেকে পৃথিবীতে ঘটনাটা পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। কতটুকু দূরে থাকলে কতটুকু সময় লাগে, সেই হিসেব থেকে তিনি তখনকার যুগের সবার চোখ কপালে তুলে দেয়ার মত একটা প্রস্তাব করলেন – আলো জিনিসটার গতি অসীম না, তারও একটা গতি আছে। আর সেই গতিটা হলো, সেকেন্ডে ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। যারা আসল গতিটা (সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার) জানেন, তারা চ্যাঁচামেচি শুরু করার আগেই জানিয়ে দিচ্ছি, আলো নিশ্চয়ই তখন ভিন্ন গতিতে চলতো না। ওনার দাবিটা আসল গতির চেয়ে ২৬% কম ছিলো। কারণ সোজা, তিনি হিসেবে কিছু ভুল করেছিলেন। ভুল বলাটা আসলে ঠিক হবে না। আসলে তখন যে যন্ত্রপাতি ছিলো, সেগুলো দিয়ে উনি যতটুকু হিসেব করতে পেরেছিলেন, সেটাই করেছেন। এরপর আস্তে আস্তে যন্ত্রের সংবেদনশীলতা বেড়েছে, আরো নিখুঁত হয়েছে। এবং আমরাও পেয়েছি আলোর বেগের সূক্ষ্ম হিসাব।
যে বিজ্ঞানী প্রথমবার এই আবিষ্কারটা করলেন, তাকে নিয়ে দুটো কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। ওলে রয়মার ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৬৪৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আধুনিক থার্মোমিটারের আবিষ্কারক। শুধু তাই নয়, তার বানানো রয়মার স্কেলকে আরেকটু উন্নত করে ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট বানিয়েছিলেন ফারেনহাইট স্কেল। যারা “ফ্ল্যাশ” কমিকস পড়েছেন বা সিরিজটা দেখেছেন, তারা জানেন যে ফ্ল্যাশ ব্যাটা অনেক জোরে দৌড়ায়। পুরনো কমিকসে বেশ কয়েকবার সে নিজের গতিবেগ মেপেছে রয়মার ইউনিট দিয়ে, সেটা ওলে রয়মারের স্মরণেই।

আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?



“আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?” – ছোটবেলা আমরা সবাই হয়তো এই খেলাটা খেলেছি। অনেক সময় আমরা মেঘের মধ্যে খরগোশ-পুতুল-মানুষের মুখ খুঁজে পেতাম। আহ ছোটবেলা।
খরগোশ?
খরগোশ?
বড়বেলায় এসেও আমাদের অনেকেই সেই ভ্রম থেকে বের হতে পারেন না। বিস্কিট-ব্রেডে যিশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে, চাঁদ-মঙ্গলে মানুষের মুখাবয়ব হয়ে, হাবলের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ছবিতে কোনো কোনো ধর্মের স্রষ্টার নাম দেখতে পাওয়া পর্যন্ত এই ভ্রম ছড়িয়ে আছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই বিশেষ ব্যাপারটিকে বলা হয় Pareidolia। উইকি মতে  para (παρά, “পাশে, পাশাপাশি, পরিবর্তে”, ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল কিছু অর্থ এই প্রেক্ষাপটে) এবং বিশেষ্য eidōlon (εἴδωλον, “চিত্র, গড়ন, আকৃতি” ) এই দুটি গ্রীক শব্দ থেকে প্যারেডোলিয়া শব্দটি এসেছে। বুঝতেই পারছেন প্যারেডোলিয়া মানে দাঁড়াচ্ছে- ত্রুটিপূর্ণ গড়ন বা আকৃতি।

কেন হয় প্যারেডোলিয়া

কারণে যাওয়ার আগে চলুন দেখে নিই কয়েকটি উদাহরণ।
ছবিটিকে বলা হচ্ছে হ্যান্ড অফ গড
ছবিটিকে বলা হচ্ছে হ্যান্ড অফ গড
যিশু?
যিশু?
মঙ্গলের ইয়েতি!
মঙ্গলের ইয়েতি!
ওবামা?
ওবামা?
মানুষের মস্তিস্কের একটা মারাত্মক ক্ষমতা হচ্ছে মুখাবয়ব চিনতে পারা, আমরা ছোটবেলা থেকেই চেহারা বা প্যাটার্ন চিনতে পারদর্শী। কার্ল সেগান মনে করতেন এর একটা বিবর্তনীয় ব্যাখা আছে, আর সেটা হচ্ছে-
“বাচ্চারা দেখা শুরু করার সাথে সাথে, আমরা দেখি, তারা চেহারা চিনতে পারে। আমরা এখন জানি যে এই ক্ষমতাটি মস্তিকে প্রোথিত আছে। মিলিয়ন বছর আগে যে বাচ্চারা তার চেহারা দেখে হাসতে পারতো না তারা হয়তো কম স্নেহ পেত, আর তাদের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম হতো হয়তো। এখনকার সময়ে সব বাচ্চাই চেহারা বুঝতে পারে, আর একটা হাসি দিয়ে প্রতিউত্তর দেয়”। (সূত্র- The Demon-Haunted World – Science as a Candle in the Dark (New York: Random House, 1995)
উনি আরো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, প্যাটার্ন চিনতে পারার ক্ষমতা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্যেও দরকার ছিলো। নক্ষত্রের অবস্থান বছরের বিশেষ একটি সময় বা ঋতুকে নির্দেশ করতো। এবং ঐ সময়ে শিকার করার পশু পাওয়া যেত, বা ফল পাকার সময় আসতো। তাই, রাতের আকাশে নক্ষত্র চেনার জন্য এবং মনে রাখার জন্য সেগুলোর মধ্যে আকৃতি খোঁজারও চেষ্টা করেছি হাজার হাজার বছর ধরে।
চেহারা আর প্যাটার্ন চিনতে পারাটা যদিও একটা লাভজনক বৈশিষ্ট্য, এর অপকারিতাও নেহায়েত কম না। নীল টাইসন খুব সুন্দর করে বলেন, “আমরা আকৃতি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে এতটাই দক্ষ যে আসলে আমরা অদক্ষ হয়ে গেছি। যা যেখানে নেই, সেটাকেও সেখানে দেখে ফেলছি।” একটা সময় হয়তো এই ক্ষমতা আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল, শিকার আর শিকারীর ব্যাপারে সাবধানতা আনতে, এখন এই ব্যাপারটা অনেকগুলা প্রভাবক দিয়ে প্রভাবিত হয় বলে তথ্যউপাত্ত আছে। আমাদের শ্রদ্ধা, কামনা, ঘোর, আকাঙ্ক্ষা প্যারেডোলিয়ার ক্ষেত্রে, এসব চিত্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। মনস্তত্ববিদেরা মস্তিস্কের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মানসিকতার বিশ্লেষণ করেন Rorschach ink blot পরীক্ষার মাধ্যমে।
এ সংক্রান্ত আলোচনায় এক ব্যক্তিকে একবার টোস্টে যিশুর ছবি দেখানো হলে সে দেখতে পায় না, কারণ এই ছবিটির সাথে তার পরিচয় কম। কিন্তু সেই একই লোক হাবলের তোলা সুপারনোভার ছবিতে নিজের স্রস্টার নামের অবয়ব খুঁজে পেয়েছিল, যেখানে এই অবয়বের সাথে অপরিচিত একজন লোক দেখছিলেন ডাইনোসরের মাথা!
কার্ল সেগান, এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের সম্মুখীন হন; প্রশ্নকর্তা জানতে চান মঙ্গলের পৃষ্ঠে মানুষের মুখের অবয়বের একটি পাহাড়ের কথা।
সেগান উত্তরে বলেন- “মঙ্গল গ্রহে একটা জায়গা আছে সিডোনিয়া নামে, ভাইকিং ১৯৭৬ এর মিশনে এই জায়গাটির অনেক ছবি তোলা হয়, এই মিশনের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম। একটা ছবিতে পাহাড় পর্বত মিলে এমন একটা জায়গা তৈরি করেছে যেটা দেখতে অবিকল একটা মানুষের চেহারার মতো মনে হয়, তিন কিলোমিটারের মতো প্রস্থ আর এক কিলোমিটার উচ্চতার একটা জায়গা। এটা মঙ্গল পৃষ্ঠে শুয়ে আছে, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এটার মাথায় একটা হেলমেটের মত কিছু দেখা যাচ্ছে, এর একটা চোখ আছে আরেকটা চোখ ছায়ায়, একটা নাকও আছে। আপনার মনে হবে এটা কৃত্রিমভাবে বানানো। আর রিচার্ড হ্যোগল্যান্ড এই ছবি দেখে বলেন মঙ্গলে পুরোনো একটা এলিয়েন জাতি ছিল। তিনি তাঁদের একটা সময়কালও ধরে দেন, ৫০০,০০০ বছর আগে বা এর কাছাকাছি। ঐ সময়ে তো আমাদের পূর্বপুরুষরা মহাকাশ ভ্রমণে যেতে পারতেন না সেটা মোটামুটি নিশ্চিত, কিন্তু এটা থেকেই অনেকে অনেক ধরনের কল্পকাহিনী বানানো শুরু করেন। “আমরা মঙ্গল থেকে এসেছি” আর “অন্য একটা নক্ষত্র থেকে এলিয়েনরা এসে মঙ্গলে এই মূর্তি বানিয়েছিল আর আমাদের পৃথিবীতে রেখে গেছে”। তবে এদের কেউই বলতে পারেন না কেনো আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীর সক্রিয় জিনের ৯৯.৬ ভাগ একই রকম। আমাদের যদি এখানে রেখেই যাওয়া হয়, তবে আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীদের এতো মিল কেনো? তাদের এই অবস্থানের ভিত্তি কী? সেই ভিত্তি কত মজবুত? আমি সাধারণত এসব তর্কের ক্ষেত্রে একটা ঘটনার কথা বলি। সাবেক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের চেহারা সম্বলিত একটি বেগুনের গল্প। বেগুনটির একটি খাড়া নাকের মত অংশ আছে- আর রিচার্ড নিক্সনকে এই বেগুনে দেখার মত মানুষের কোনো অভাব নেই। এই ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝবো? এলিয়েনরা আমাদের বেগুন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে? নাকি এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা? নাকি ঈশ্বর বেগুনের মাঝে করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন? অথবা, ইতিহাসে হয়তো হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বেগুন ছিল যেগুলো দেখতে সাধারণ বেগুনের মতো ছিলো না, আর এই বড় সংখ্যার বেগুনের মাঝে ২/১টা বেগুন দেখে আমাদের মানুষের চেহারার মতো মনে হতেই পারে। আমরা মানুষরা চেহারা বুঝতে পারদর্শী। আমার মনে হয় পরের কারণটা যৌক্তিক। এবার মঙ্গলের চেহারাটা দেখা যাক…হাজার লক্ষ পাহাড় আর টিলার হাজার লক্ষ রকম বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা এমন একটা দেখলাম যেটা মানুষের চেহারার মতো দেখতে। ছবির আলোকপাতের পরিবর্তন করলে দেখা যায় এটাকে আর চেহারা মনে হয় না। আবারো বলি, আমরা চেহারা চিনতে পারদর্শী। হাজার লক্ষ পাহাড়ের মাঝে একটা পাহাড় দেখতে মানুষের চেহারার মতো, এটা কি এলিয়েনদের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ? আমার মনে হয় না। আমি সেই লোকদের দোষ দিচ্ছি না যারা নাসার আর্কাইভ থেকে এসব ছবি খুঁজে বেড়ান, এটা বৈজ্ঞানিক মনোভাব। আমি তাদেরও দোষ দিচ্ছি না যারা এলিয়েনদের বা তাদের চিহ্ন খুঁজছেন, আমার মনে হয় এটা ভালো বুদ্ধি। কিন্তু আমার সমস্যা তাদের ক্ষেত্রে যারা অতিরঞ্জিত আর অপ্রতুল প্রমাণকে নিশ্চিত প্রমাণ বলে প্রচার করেন”।
মঙ্গলের মুখ
মঙ্গলের মুখ
সাক্ষাৎকারটা ১৯৯৬ সালের। পরে নাসা মঙ্গলের আরো ছবি প্রকাশ করেছে, আর স্বভাবতই মানুষ সেখানে খুঁজে পেয়েছে নারী, কুকুর, ষাঁড়, বৌদ্ধের প্রতিমা আরো নানান কিছু। সবাই কেনো ধরে নিচ্ছে মঙ্গলে যদি কোনো প্রাণী থেকেই থাকে সেগুলো আমাদের পরিচিত প্রাণী বা জিনিসের মতোই হবে দেখতে? কেনো কেউ ভাবছে না অপরিচিত স্থানে পরিচিত কিছুর অবয়ব খুঁজে পাওয়া হয়তো দর্শকের ভুল? বা সেই ভুল থেকে মানুষ গড়ে তুলছে আশ্চর্য উপসংহার, মেনে নিচ্ছে অনস্তিত্বশীল জিনিসের অস্তিত্ব।
সুপারনোভার মত এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যার চাপ ও তাপে আমাদের মহাবিশ্বের সকল ভারী মৌলের জন্ম, যে বিস্ফোরণে আশেপাশের গ্রহ, সৌরজগত ছিন্ন বিচ্ছিন হয়ে যায়, সেখানে মানুষ খুঁজে নিচ্ছে পরম করুণাময়, পরম দয়ালু ঈশ্বরের নামের অস্তিত্ব? এই দ্বিমুখিতা কারো কাছে সন্দেহজনক মনে হয় না কেনো?

Comments

Popular posts from this blog

Privacy Policy & App Related Query