মহাবিশ্বের ইতিহাস
ইতিহাস
প্রাচীন কালে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য নানাবিধ বিশ্বতত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া হত। পুরাতন গ্রিক দার্শনিকরাই প্রথম এই ধরণের তত্ত্বে গাণিতিক মডেলের সাহায্য নেন এবং পৃথিবী কেন্দ্রিক একটি মহাবিশ্বের ধারণা প্রণয়ন করেন। তাঁদের মডেলে পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহ, সূর্য ও নক্ষত্ররা ঘুরছে। গ্রীকদের এই মডেলে মহাবিশ্বের মোট আয়তন বর্তমানে জ্ঞাত বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মধ্যেই ছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন আকাশের তারারা আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়।
বেশ কয়েক জন জ্যোতির্বিদ পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেও যতদিন না চৌদ্দশো শতকে কোপের্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে যৌক্তিক ভাবে তাঁর বইয়ে উপস্থাপনা করলেন ততদিন পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণা মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে গেঁড়ে ছিল। পরবর্তীকালে নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ সংক্রান্ত গভীর ধারণা পর্যবেক্ষণের সাথে সৌরকেন্দ্রিক জগতের সামঞ্জস্য নির্ধারণ করে। ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেন সূর্যের মতই কোটি কোটি তারা দিয়ে একটি গ্যালাক্সি গঠিত। কয়েক শত বছর বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সমগ্র মহাবিশ্ব মানে শুধুমাত্র আমাদের এই ছায়াপথ গ্যালাক্সিটিই। ১৯২০র দশকে উন্নত দুরবীনের কল্যাণে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন ছায়াপথের বাইরে অন্য গ্যালাক্সিদের।
সেই কোটি কোটি গ্যালাক্সিদের মধ্যে ছায়াপথের মতই কোটি কোটি তারাদের অবস্থান। সেই সমস্ত গ্যালাক্সিদের থেকে আগত আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণে বোঝা গেল সেই গ্যালাক্সিগুলি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এর সহজতম ব্যাখ্যা হল গ্যালাক্সিদের মধ্যে স্থানের প্রসারণ হচ্ছে এবং প্রতিটি গ্যালাক্সিই অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা হল সুদূর অতীতে সমস্ত গ্যালাক্সিগুলি বা তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত পদার্থই একসাথে খুব ঘন অবস্থায় ছিল এবং কোন মহা বিস্ফোরণের ফলে বস্তুসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হল বিগ ব্যাং। ১৯৬০এর দশকে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাংএ সৃষ্ট উষ্ণ বিকিরণের শীতল অবশেষের সন্ধান পেলেন।[১০] এই তরঙ্গ বিগ ব্যাং ঘটনার প্রায় ৪০০,০০০ বা চার লক্ষ বছর পরে, বস্তু ঘনত্বের হ্রাসের পর, মুক্ত হয়েছিল। এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মহাবিশ্বের প্রতিটি জায়গাতেই পাওয়া যায়। এক অর্থে বলা যায় এই তরঙ্গ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ ত্বরাণ্বিত হচ্ছে। এই আবিষ্কারটি বিশ্বতত্ত্বের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিল।
বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা ভীষণ ঘন ও উষ্ণ দশা থেকে। এই সময় বা অবস্থাকে প্ল্যাঙ্ক ইপোখ বলে অভিহিত করা যায়। সেই সময় থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা শুরুর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই (১০−-৩২ সেকেন্ডের মধ্যেই) মহাবিশ্বের অতি স্ফিতী (inflation) হয় যা কিনা দেশ বা স্থানের প্রতিটি অংশে প্রায় একই তাপমাত্রা স্থাপন করতে সাহায্য করে।এই সময়ে সুসম ঘনত্বের মাঝে হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যত গ্যালাক্সি সৃষ্টির বীজ তৈরি হয়। মহাকর্ষ শক্তি মাধ্যমে সম্প্রসারণের বিরূদ্ধে বস্তুজগতকে আকর্ষিত করে গ্যালাক্সি সৃষ্টির পেছনে কৃষ্ণ বা অন্ধকার বস্তুর বিশেষ ভূমিকা আছে। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণের মাত্রার ত্বরণের জন্য কৃষ্ণ বা অন্ধকার শক্তি বলে একটি জিনিসকে দায়ী করা হচ্ছে। তাত্ত্বিক ভাবে কৃষ্ণ বস্তু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য বলগুলোর সাথে (তড়িৎ-চুম্বকীয়, সবল ও দুর্বল) খুব অল্পই বিক্রিয়া করে সেইজন্য ডিটেকটর দিয়ে তাকে দেখা মুশকিল। বর্তমান মহাবিশ্বের মূল অংশই হচ্ছে কৃষ্ণ শক্তি, বাকিটা কৃষ্ণ বস্তু। আমরা চোখে বা ডিটেকটর মাধ্যমে যা দেখি তা মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশের কম। এই মডেলে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়েস ১৩.৭৫ বিলিয়ন বা ১,৩৭৫ কোটি বছর। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের "এই মুহূর্তের" ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোক বছর। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিটি বিন্দু থেকে প্রতি মুহূর্তে আরো দ্রুত সরছে, মহাবিশ্বের ব্যাস ১৩.৭৫ x ২ = ২৭.৫০ বিলিয়ন আলোক বছরের চাইতে বেশী। দেশ বা স্থানের প্রতিটি বিন্দু বহু দূরের কোন বিন্দুর তুলনায় আলোর গতির উর্ধে ভ্রমণ করে, যতক্ষণ না সেই বিন্দুগুলির মাঝে তথ্য আদানপ্রদান না হচ্ছে এই গতি বিশেষ বা সাধারণ আপেক্ষিকতার কোন নিয়ম ভঙ্গ করে না।
বর্তমান মহাবিশ্বের উপাদান সমূহ
মহাবিশ্বের আকার বিশাল। বর্তমান বিশ্বতত্ত্বের মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের বর্তমান বয়েস ১৩.৭৫ বিলিয়ন বা ১,৩৭৫ কোটি বছর। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের "এই মুহূর্তের" ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোক বছর। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিটি বিন্দু থেকে প্রতি মুহূর্তে আরো দ্রুত সরছে, মহাবিশ্বের ব্যাস ১৩.৭৫ x ২ = ২৭.৫০ বিলিয়ন আলোক বছরের চাইতে বেশী। দেশ বা স্থানের প্রতিটি বিন্দু বহু দূরের কোন বিন্দুর তুলনায় আলোর গতির উর্ধে ভ্রমণ করে, যতক্ষণ না সেই বিন্দুগুলির মাঝে তথ্য আদানপ্রদান না হচ্ছে এই গতি বিশেষ বা সাধারণ আপেক্ষিকতার কোন নিয়ম ভঙ্গ করে না। কাজেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে মহাবিশ্বকে যদি একটা গোলক কল্পনা করা হও তবে তার ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন আলোক বর্ষ। যদিও সেই দূরত্ত্বে অবস্থিত গ্যালাক্সি থেকে এই মুহূর্তে যে বিকিরণ বার হচ্ছে তা আমরা কখনই দেখতে পাব না।
জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন (১০+১১) গ্যালাক্সি আছে। এই গ্যালাক্সিরা খুব ছোট হতে পারে, যেমন মাত্র ১০ মিলিয়ন (বা ১ কোটি) তারা সম্বলিত বামন গ্যালাক্সি অথবা খুব বড় হতে পারে, দৈত্যাকার গ্যালাক্সিগুলিতে ১০০০ বিলিয়ন তারা থাকতে পারে (আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের ১০ গুণ বেশী)। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আনুমানিক ৩ x ১০+২৩টি তারা থাকতে পারে।[১৩]
বর্তমানের মহাজাগতিক মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের মূল উপাদান মূলতঃ কৃষ্ণ বা অন্ধকার শক্তি। ধরা হচ্ছে যে এই শক্তি সারা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং মহাবিশ্বের প্রসারণের পিছনে মূল ভূমিকা পালন করছে। কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ যেখানে ৭৪% ভাগ ধরা হয়, মোট বস্তুর পরিমাণ সেখানে ২৬%। কিন্তু এই বস্তুর মধ্যে ২২% কৃষ্ণ বস্তু ও ৪% দৃশ্যমান বস্তু। কৃষ্ণ বস্তুর অস্তিত্ব পরোক্ষভাবে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন, গ্যালাক্সিপুঞ্জ, মহাকর্ষীয় লেন্সিং, ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। কৃষ্ণ বস্তু যেহেতু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য কোন বলের সংঙ্গে পারতপক্ষে কোন মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না, সেই জন্য তাকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা কঠিন।
মহাবিশ্বের সংঙ্গে আমাদের পরিচয় দৃশ্যমান বস্তুর আঙ্গিকে। পরমাণু ও পরমাণু দ্বারা গঠিত যৌগ পদার্থ দিয়ে এই দৃশ্যমান বিশ্ব গঠিত। পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত। প্রোটন ও নিউট্রনকে ব্যারিয়ন বলা হয়। ব্যারিয়ন তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। অন্যদিকে দুটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত কণাদের মেজন বলা হয়। অন্যদিকে লেপটন কণা কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত নয়। সবেচেয়ে পরিচিত লেপটন কণা হচ্ছে ইলেকট্রন। প্রমিত মডেল বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল কোয়ার্ক, লেপটন ও বিভিন্ন বলের মিথষ্ক্রিয়ায় সাহায্যকারী কণাসমূহ (যেমন ফোটন, বোজন ও গ্লুয়োন) দিয়ে তৈরি। বর্তমানের কণা পদার্থবিদ্যাকে ব্যাখ্যা করতে এই মডেল সফল হয়েছে।
Comments
Post a Comment